ওয়ান পিসে দুনিয়া মাত

0

টুকটাক হাতের কাজ করতেন আগে থেকেই। ২০০৪ সালে মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন এক জন তরুণী। হাতের কাজ, ব্লক, বাটিক, এমব্রয়ডারী এবং নকশার কাজ নিয়ে তিনি তার ব্যবসায় পথ চলা শুরু করলেন। আজ ২০১৬ সাল- সেই তরুণী আজকে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে পরিচালনা করছে প্রায় ৩৫ জন নিয়মিত কর্মী, ৩০০ জন চুক্তি ভিত্তিক কর্মী এবং সারা বাংলাদেশে নানান নেটওয়ার্ক এ কাজ করে তিনি পরিচালনা করছেন তার হস্তশিল্প।

চিত্রঃ উদ্যোক্তা তার কর্মসময়ে

২০০২ সালে, ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় উদ্যোক্তা আনোয়ারা আক্তার শিউলির। হাতের কাজ টুকটাক জানাই ছিল। ২০০৪ সালে, অর্থাৎ বিয়ের দুবছর পরপর নিজের পায়ে দারাবার প্রত্যয়ে মায়ের কাছ থেকে মাত্র ৫ হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তরুণ এই উদ্যোক্তা। ব্লক, বাটিক, হাতের নকশার কাজ করা শুরু করলেন আনোয়ারা। টোলারবাগে আটশ পঞ্চাশ স্কয়ার ফিটে ব্যাগ, পুতি দিয়ে ফলমূল, থ্রিপিস, বেড কাভার তৈরি করতে শুরু করলেন।

চিত্রঃ উদ্যোক্তা ও তার কর্মীগণ কাজে ব্যস্ত

এলাকার প্রতিবেশি, আত্নীয়-স্বজন সকলের পছন্দ মত সেগুলো তৈরি করে দিতেন আনোয়ারা। ৫ হাজার টাকা দিয়ে ১০ টি থ্রিপিস বানিয়ে ছিলেন। সেই থ্রিপিস গুলো বিক্রি করলেন ভালো দাম দিয়ে। ১০ হাজার টাকা হাতে আসলো। সুন্দর করে মন দিয়ে নিজের নকশায় কাজ করে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব এই ধারণা দৃঢ় হলো আরও অনেক বেশি উদ্যোক্তা আনোয়ারার। এবার পুরোপুরি ময়দানে নামা। তিন মাস পরই নিজের বোন তাকে দিলেন ৫০ হাজার টাকা। ইসলামপুরে ১০ বড় থান কেনা হলো ভীষন উৎসাহ নিয়ে। ৫০ টি থ্রিপিস তৈরি হবে, ২০ টি টু-পিস। হলোও তাই, ৭০ টি পোশাক তৈরি করলেন।

উদ্যোক্তার সফলতার গল্প দেখুন ইউটিউবে-দেখতে ক্লিক করুন

এলাকার চেনাজানা লোকজন, বোন, শাশুরি মা, আত্নীয়-স্বজন সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিলেন এবং সকলে মিলেই কিনে ফেল্লেন, বিক্রি হয়ে গেল ৭০ টি পোশাক। এভাবেই ধিরেধিরে নিজের একটি পরিচয় খুঁজে পেতে থাকেন আনোয়ারা। নিজে হয়ে উঠতে থাকেন স্বাবলম্বী নিজের কর্মে। নিজের তৈরি করা পোশাক এনে দেয় আত্ন-প্রত্যয়, দেখায় এগিয়ে চলার শক্তি।

চিত্রঃ উদ্দ্যোক্তা আনোয়ারা শিউলির তৈরি করা পোষাক

স্বামী ইসমাইল হোসেন ইউনুস এবার উৎসাহ দিয়ে সময় নিয়ে পাশে দাঁড়ালেন। দুটি এমব্রয়ডারী মেশিন কিনলেন উদ্যোক্তা আনোয়ারা এবং স্বামী উপহার দিলেন একটি ব্লক এর টেবিল। নতুন গতিতে উদ্যোক্তার যাত্রা হয় শুরু। স্বামী নিয়মিত সঙ্গী হলেন কাপড়, থান এবং কাঁচামাল কিনবার। উদ্যোক্তা এবার জামালপুরে তার কাজ শুরু করলেন নানান কর্মীদের কে নিয়ে। ১০ টি গ্রুপে কর্মীদেরকে কাজ দেয়া শুরু করলেন। প্রতিটি গ্রুপে ১০ জন, অর্থাৎ মোট ১০০ জন কর্মী। প্রতি ১৫ দিন পরপর কাজ তুলে নিতেন। এভাতে বাড়তেই থাকে কাজের চাহিদা। নিত্য নতুন নানান ডিজাইনে আনোয়ারা আক্তার উপহার দিতে থাকলেন তার কাজ ক্রেতাদের কাছে এবং সেই সাথে সুনাম ছড়িয়ে পড়ল আনোয়ারার। পরের বছরেই নতুন তিনটি মেশিন কেনা হলো। ২০০৮ সালে প্রথম ফ্যাক্টরিটি দিলেন ঘরেই পাঁচশ স্কয়ার ফিট, ছাপাখানা মোড়। কাজের অর্ডার বাড়ছে, বাড়ছে ক্রেতার সংখ্যা। শাওন হস্তশিল্প গড়ে তুললেন। কর্মী বাড়তে থাকলো। টু-পিস, থ্রি-পিস, বেডশিট, কুশন কাভার, ফতুয়া ঈদে এবং নানান উৎসবে আয়োজনে পাঞ্জাবী নানান পোশাকের অর্ডার মত।

চিত্রঃ কর্মীগণ অর্ডারের কাজে ব্যস্ত

উদ্যোক্তা আনোয়ারা শিউলি জানান যে একটি ব্যবসায় পরিচালনার জন্যে মূলধনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো একজন উদ্যোক্তা তার মনোবল, জ্ঞানবুদ্ধি এবং আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে, নিজের তৈরি করা পণ্য ক্রেতা বা ভোক্তাদের নিকট পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে, নিজে নিজে কিছু করবার তাগিদটিকেই একজন উদ্যোক্তা সফল উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ পরিচালনা করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, এই হস্তশিল্পের কাজ বেছে নেয়ার কারণ জানতে চাইলে যে প্রথমমত তিনি একজন মা, তিনি তার সন্তানকে সময় দিতে পারেন এবং তার পাশাপাশি নিজের কাজ করার ইচ্ছেটিকে বাস্তবায়ন করতে পারেন।

২০১০ সাল, মাইডাস থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার একটি ঋণ নিলেন উদ্যোক্তা।। খুব তারাতারি কাজ তুলে তুলে সেটা পরিশোধ করে দিলেন। ২০১১ সাল, ব্যাংক এশিয়া এসে দাঁড়াল উদ্যোক্তার পাশে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক বিনা শর্তে গুণবতী ঋণ দিলেন উদ্যোক্তা কে ৭ লক্ষ টাকা ব্যবসার প্রসার ঘটাবার জন্য। উদ্যোক্তার কর্মী সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। প্রায় ২০০ জন চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পেলেন উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানে কর্মী হিসেবে। এই কর্মীদের কে জামালপুরে গিয়ে নিজে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসেন উদ্যোক্তা আনোয়ারা। এছাড়াও নিয়মিত কর্মী বেড়ে দাঁড়িয়েছে, প্রায় ১৫ জন মিলে কাজ তুলতে থাকেন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায় উদ্যোক্তা।২০১৪ সাল, এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে ফ্যাশন ডিজাইনে কোর্স করলেন আনোয়ারা। উদ্যোক্তার জীবন যেন পাল্টে গেল।এবার ডিজাইনার হিসেবে উদ্যোক্তা আনোয়ারা নিজেকে করলেন আবিষ্কার। উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানে কর্মী বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ জন। ইন্টারনেটে নিয়মিত ডিজাইন নিয়ে পড়াশুনা, শাওন হস্তশিল্পের ক্রেতারা আসেন ডিজাইনার উদ্যোক্তা আনোয়ারার ডিজাইনে মুগ্ধ হয়ে কিংবা আসেন আনোয়ারার বিশাল কর্মী বাহিনীর কাছ থেকে পছন্দের ডিজাইনের পোশাক টি বানিয়ে নিতে। ছোট্ট ছোট্ট অনেক গুলো সম্মাননা মিলেছে, প্রতিবেশী কুটির শিল্পে অ্যাওয়ার্ড, যেখান থেকে কাজ শিখেছেন উদ্যোক্তা। সেরা ১০ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জাতীয় জাদুঘরে পেয়েছেন একটি অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৩ সালে ক্যানাডায় পেয়েছেন এনলিস্টমেন্ট একজন সফল নারী ব্যবসায়ী হিসেবে। ২০১৬ সালে, ৫ হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করা সেই তরুণ উদ্যোক্তা আজ সফল ভাবে পরিচালনা করছেন ৩৫ লক্ষ টাকা মূল্যমানের ব্যবসা।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here