সফল উদ্যোক্তা মায়ের সফল ছেলে

এমনও সময় ছিল যখন স্কুলে গেলে আমার ছেলের সাথে অন্য ছাত্ররা মিশতে চাইতো না। একসাথে বসতে চাইতো না। কারণ আমার মত অন্য মায়েরা সেলাই এর কাজ করত না।

তখন ছেলেকে শুধু শান্তনা দিয়ে বলতাম একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, তবে তোমাকে অনেক ভাল করে পড়াশুনা করতে হবে। আজ সেই সব দিনের কথা আমার খুব মনে পড়ছে।

ময়মনসিংহ সরকারি জেলা স্কুলের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টও রাতের আঁধারে ম্যাচ ও মোমবাতির আলো নিয়ে গিয়ে দেখে এসেছি, কারণ যদি চান্স না পায় সেই অপরাধটাও তো আমাকে নিতে হবে। কিন্তু না, আমার বাবা আমাকে অপরাধী করেনি, ঠিকই সে ভর্তি যুদ্ধে জয়ী হয়ে সরকারি স্কুলে চান্স পেয়েছে।

উদ্যোক্তা মায়ের ছেলে ও মেয়ে

আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া জানাই মাত্র দুই হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে আমার স্বপ্নের পথে হেঁটে চলা এখন ময়মনসিংহে আমার একটি ফ্যাক্টরি যেখানে প্রায় ২০০ জন নারী আমার সাথে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত থেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। ময়মনসিংহে একটি শোরুম ও ঢাকায় একটি শোরুম আছে। এছাড়া দেশের বাইরে বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহন করে আমার পণ্যের বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।

আমি ভারতে ৫ বার গিয়েছি, গিয়েছি চীন এবং নেপাল। আগামী ৭-১১ নভেম্বর ২০১৮ মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক মেলায় যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

আমার ছেলের সাথে স্কুলে কেউ মিশতে চাইতো না আমার কাজের কারণে, তখন শুধু বলতাম একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

আজ এই আমিটাকেই বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় যুবদিবস-২০১৬ তে পুরস্কার দিয়েছেন, আমাকে উনি সুযোগ করে দিয়েছেন আরও নতুন আঙ্গিকে স্বপ্ন দেখার এবং তা বাস্তবায়ন করার।

ঠিক একইভাবে আমার জীবনের আমার পরিবার থেকে আরও একটি নতুন অধ্যায় যোগ করে দিলো, আমার জীবনে সকল কাজের চালিকাশক্তি আমার সেই ছেলে খন্দকার শিহাব শাহরিয়ার। কিছু আনন্দ আছে যা মানুষের চোখে পানি এনে দেয়। সুখে বা দুঃখে জীবনে অনেক বারই কেঁদেছি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন আমাকে পুরস্কার দিয়ে কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন সেইদিন আর আজকে আমার জীবনের চালিকাশক্তি আমার ছেলে যার সফলতা আমার চোখে জল এনে দিয়েছে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে আমার ছেলে। এ কান্না সেই দিনের মুখ লুকিয়ে কান্না নয়, এ কান্না সুখের কান্না।

ডাক্তার বলেছিল ছেলে আর মাত্র এক মাস বাঁচবে। তখন আমার ছেলে খন্দকার শিহাব শাহরিয়ার এইচ.এস.সি প্রথম বর্ষের ছাত্র। ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে পড়ে। পিজি হাসপাতালে আড়াই মাস মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলো, এরপর ওকে বেঙ্গালুর নিয়ে যাই। সব ডাক্তাররাই বলেছেন যে কয়দিন আর বাঁচবে, পড়াশুনার কথা চিন্তাই করা যাবেনা। কিন্তু এ কথা আমার ছেলে মানতেই রাজী ছিলোনা। আমার ছেলে আমাকে বলেছিলো “আম্মু আমার বুকের মধ্যে বই নিয়ে ঘুমাবো, বই আমাকে ছেড়ে যাবেনা”। ডাক্তার আসলেই বই লুকিয়ে রাখতাম। ডাক্তার হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার কথা বলছিলো কিন্তু সেখানেও আমরা নিরাশ ছিলাম, কারণ এত টাকা কোথায় পাবো? আল্লাহর উপর ভরসা রেখে বাংলাদেশে ফিরে আসি।

ছেলে অনেক কান্নাকাটি করছে, এইচ.এস.সি পরিক্ষা দিবে। কিন্তু কোন প্রাইভেট কোন কোচিং ছাড়া কিভাবে সম্ভব? এই অসম্ভবকে সম্ভব করা খুবই কঠিন। রাতের পর রাত ছেলের পাশে শুয়ে শুয়ে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছি, ছেলে শুধু চোখ দিয়ে দেখে যাচ্ছে। এভাবেই চলছিলো পড়াশুনা।

ফাইনাল পরীক্ষার সময় ডাক্তার বললেন যেহেতু হার্টের সমস্যা, যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তাই ডাক্তার এবং অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হলো। সিট পড়েছিলো মোমেনুন্নেছা সরকারি কলেজে। আল্লাহর অশেষ রহমতে সবগুলো পরীক্ষাই খন্দকার শিহাব শাহরিয়ার ভালভাবে দিলো এবং গোল্ডেন জি.পি.এ ৫ পেল।

পরিবারের আনন্দঘন মূহুর্ত

বিন্দু বিন্দু সফলতা- পঞ্চম শ্রেনীতে ট্যালেন্টপুল এ বৃত্তি, এস.এস.সি গোল্ডেন, এইচ.এস.সি গোল্ডেন, সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগ অর্জন করে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আনন্দঘন একটা পরিবেশ এবং আমার স্বপ্নগুলোকে আরও ত্বরান্বিত করার সুযোগ করে দিলো।

এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় এক চান্সে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় চান্স পায়, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে সম্ভব হলোনা এখানে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কোচিং ছাড়াই পরীক্ষা দেয় এবং মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগে ভর্তি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ এর সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আনন্দঘন পরিবেশ আমাদের উপহার দিলো প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে।

আজ আমি মা হিসেবে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাই, আমার সন্তানকে এতদূর নিয়ে আসার জন্য সফল করবার জন্য। আমার ছেলের জন্য সবাই দোয়া করবেন।

 আইনুন্নাহার 
জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সফল নারী উদ্যোক্তা, ময়মনসিংহ

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here