শাহজাদ ইউনাস যখন স্টেজে এলেন, তখন তিনি মানসিকভাবে বেশ দুর্বলই ছিলেন। এই ব্রিটিশ উদ্যোক্তার বয়স ছিলো ৩২ বছর। সেদিন তিনি স্যান ফ্রান্সিকোতে একদল সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীর সামনে লন্ডন-ভিত্তিক ‘মুজম্যাচ’ নিয়ে কথা বলছিলেন।
তার বক্তৃতার শুরুটা ছিলো এমন যে, ‘মুসলমানরা ডেট করে না, তারা বিয়ে করে’। উদ্যোক্তা শাহজাদ এবং তার ব্যবসার অংশীদার রায়ান ব্রডি সেখানে গিয়েছিলেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে।
সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াই কমবিনেটর’ প্রতিবছর বিজয়ীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে, এটাই ছিলো প্রতিযোগিতার পুরস্কার। মার্কিন এই কোম্পানিটি বেশ কয়েকটি স্টার্ট-আপকে প্রতি বছর আর্থিক ও প্রয়োগিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
মুজম্যাচ যে বছর আবেদন করে, তখন মোট আবেদনের সংখ্যা ছিলো ১৩ হাজার। আর মুজম্যাচ সহ ৮০০ স্টার্ট-আপের প্রতিষ্ঠাতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় তাদের উদ্যোগ নিয়ে কথা বলতে।

উদ্যোক্তা শাহজাদ যখন তার বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মাঝেমধ্যেই বিনিয়োগকারীরা হাসিতে ফেটে পড়ছিলেন। কারণ তিনি একেবারে খোলামেলা কথা বলছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে মুজম্যাচকে দেয়া হলো ১৫ লক্ষ ডলার। ২০১৭ সালে যে ১০০ স্টার্ট-আপ সহায়তা পায় তারা ছিলো তাদের মধ্যে অন্যতম। দ্রুত বেড়ে ওঠা এই কোম্পানি সম্পর্কে উদ্যোক্তা শাহজাদ জানান, ‘যুক্তরাজ্য এবং আরো ৯০টি দেশে তাদের ১০ লক্ষেরও বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে’।
উদ্যোক্তা শাহজাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ম্যানচেস্টার শহরে। উদ্যোক্তা শাহজাদ লন্ডনের একটি ব্যাংকে কাজ করতেন। তিনি কাজকে ভালোবাসতেন। কাজের পাশাপাশি তিনি এটাও বুজতে পেরেছিলেন যে মুসলমানরা নিজেদের ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভেতর থেকেই জীবন সঙ্গী খুঁজছেন। কিন্তু তাদের জন্য ভালো কোনো ডেটিং অ্যাপ বাজারে নেই। সে সময়ে মুসলমানদের জন্য খুব সাধারণ ধরণের ওয়েবসাইট ছিলো, অথবা ছিলো বড় বড় ডেটিং অ্যাপ যেগুলো ঠিক মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ার মতো না।
আমাদের সমাজে মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ে আমরা স্ত্রী বা স্বামী খুঁজতে ঘটকদের ওপর নির্ভর করে থাকি। বর্তমান সময়ে এখনো অনেকে তাই করেন। এরা এক বাড়ির ছেলের সঙ্গে আরেক বাড়ির মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন।

উদ্যোক্তা, শাহজাদের আইডিয়া ছিলো একটি ডিজিটাল ম্যাচমেকার অ্যাপ তৈরী করা সেসব মুসলমানদের জন্য যারা বিয়ে করতে পাত্র-পাত্রী খুঁজছে। কিন্তু ভাগ্যের এক নিষ্ঠুর পরিহাস, ২০১৩ সালে চাকরি হারালেন শাহজাদ। আর তখনই তিনি ঠিক করলেন এই অ্যাপ নিয়ে তিনি এবার মাঠে নামবেন।
এর পর উদ্যোক্তা প্রতিদিন সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে রাট ২ টায় ঘুমাতে যেতেন। তার নিজ বাড়িতে শোবার ঘরে বসেই কাজ করতেন।আর ভাবতেন কিভাবে অ্যাপ বানাতে হয়, যা তাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিলো।
উদ্যোক্তা শাহজাদ জানতেন তাকে একটা ভালো মানের অ্যাপ বানাতে হবে। মনে মনে ভাবতেন যে সুযোগটি বিশাল- পুরো দুনিয়াতে ১৮০ কোটি মুসলমান রয়েছে, কিন্তু এটা স্পষ্ট কেউ তাদের প্রয়োজনের কথা ভাবছে না।
শাহজাদ ২০১৪ সালে খুব অনাড়ম্বরভাবে অ্যাপটি শুরু করেন। বড় বড় ডেটিং অ্যাপগুলো থেকে তার বিপণন কৌশল ছিলো কিছুটা আলাদা।
উদ্যোক্তা প্রতি শুক্রবার নামাজের পর মসজিদে যেতেন আর নামাজ শেষে সবাইকে অ্যাপটির কার্ড দিতেন। এরপর উদ্যোক্তা যে কোনো মুসলিম পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়ে গাড়ির কাঁচে ভিজিটিং কার্ড আটকে দিতেন। যে কোনো ব্যবসা গড়ে তোলা বেশ কঠিন এবং এটা বেশ যন্ত্রণাদায়কও।
উদ্যোক্তা ‘মুজম্যাচ’ অ্যাপটি শুরুতে মাস দু’য়েক সবসময় গুগল অ্যানালাইটিকস দেখতেন এটা জানার জন্য যে নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক কত মানুষ অ্যাপটি ব্যবহার করছে। পরবর্তী এক দিন উদ্যোক্তা শাহজাদ দেখলেন মাত্র ১০ জন ‘মুজম্যাচ’ ব্যবহার করছেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলেছে। দেখেছেন যে হাজার হাজার মানুষ এটি ব্যবহার করেছে, কারণ মানুষের মুখে মুখে কথা ছড়িয়েছে। লোকজন একটা সময় শাহজাদকে বলা শুরু করলো যে ঠিক কীভাবে তারা তাদের ভবিষ্যত স্ত্রী বা স্বামীকে খুঁজে পেয়েছে। উদ্যোক্তা যখন তার ‘মুজম্যাচ’ অ্যাপটি নিয়ে সাফল্যের কথা চারিদিকে শুনতে পেলেন তখন নিশ্চিত বুঝতে পারলেন তিনি সঠিক পথে আছেন এবং ‘মুজম্যাচ’ অ্যাপটি একটা সময় দাঁড়িয়ে যাবে।
ব্যবসায়ের অংশীদার রায়ান যোগ দিলেন ২০১৬ সালে। বয়স মাত্র ২৫ হলেও অ্যাপ বানাতে রায়ান ছিলেন একজন ঝানু লোক। দু’জনে মিলে মুজম্যাচকে নতুন করে সাজালেন।
পরবর্তীতে এই ‘মুজম্যাচ’ অ্যাপটিতে উদ্যোক্তারা আরো ২২টি প্রোফাইল প্রশ্ন যোগ করলেন, যেমন একজন ব্যবহারকারী কতটা ধার্মিক, অথবা দিনে কয়বার নামাজ পড়েন। এসব প্রশ্ন ব্যবহারকারীদের কাছে ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ‘মুজম্যাচ’ অ্যাপটিতে উদ্যোক্তার এমন কিছু সুযোগ ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন যে ব্যবহারকারীরা চাইলে তার প্রোফাইল ছবি নাও দিতে পারতেন, অথবা খানিকটা অস্পষ্ট করে দিতে পারতেন।

‘মুজম্যাচ’ অ্যাপটিতে যে চ্যাট হতো, ব্যবহারকারীরা তা তাদের সম্মতিতে বাবা-মায়ের যে কোনো একজন কিংবা একজন অভিভাবকের কাছে পাঠানোর অপশনও এতে ছিলো।
উদ্যোক্তা শাহজাদ বলেন, ‘একজন মুসলমান না হলেও রায়ান বুঝতে পেরেছিলেন অ্যাপটি ঠিক কিভাবে, কেমন করে বানাতে হবে’।
মুজম্যাচ তাদের দ্বিতীয় অফিসটি খুলেছে বাংলাদেশে। তাদের বিজনেস মডেলটিকে বলা হচ্ছে ‘ফ্রিমিয়াম’- অর্থাৎ বেসিক সার্ভিসটি পাওয়া যাবে বিনামূল্যে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি চাইলে মাসে ১০ পাউন্ড করে দিতে হবে। অতিরিক্ত সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে যত খুশী সংখ্যক প্রোফাইল দেখা এবং আপনার নিজের প্রোফাইল আরো বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানো।
উদ্যোক্তা শাহজাদ বলছেন, অ্যাপটির জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে, কারণ এর সম্ভাব্য ব্যবহারকারী হলো ৪০ কোটি মুসলমান। আর তাদের বাৎসরিক আয়ের পরিমাণ ৪৫ লক্ষ পাউন্ড।
পরিশেষে উদ্যোক্তা বলেন, ‘যদি ধর্ম এবং ডেটিং ঠিক ঠিক ভাবে মিলে যায়, তাহলে তা হওয়া উচিত পবিত্রভাবে। আমাদের কারণে হাজার হাজার বিয়ে এবং বাচ্চা হয়েছে। তাদের কথা ভাবলেই মনে হয় আমাদের শুরুর কষ্ট সার্থক হয়েছে’।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)